
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ
হলো মাধ্যমিক শিক্ষা। আর
এই স্তরের প্রায় ৯৪
শতাংশ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করে বেসরকারি
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। অথচ,
অবাক করার মতো বিষয়
হলো, এই বিশাল শিক্ষাব্যবস্থার
অন্যতম চালিকাশক্তি—বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বছরের পর বছর
ধরে চরম অবহেলা, বঞ্চনা
ও বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন।
বেতন কাঠামোঃ এক অবর্ণনীয় প্রহসন
বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত বেতন
কাঠামো এতটাই হাস্যকর যে,
সেটি যেন এক প্রহসনের
নামান্তর। একজন
শিক্ষককে মাসে ১২ হাজার
৫০০ টাকা বেতনে নিয়োগ দেওয়া
হয়। বিএড
ডিগ্রি অর্জন করলে এটি
মাত্র ১৬ হাজার টাকায়
উন্নীত হয়। এছাড়া
বাড়িভাড়া হিসেবে দেওয়া হয়
মাত্র এক হাজার টাকা এবং চিকিৎসা
ভাতা মাত্র ৫০০ টাকা। সামগ্রিকভাবে
এই সীমিত আয়ের মধ্য
থেকেই আবার ১০ শতাংশ কেটে
নেওয়া হয় পেনশন ও
অবসরকালীন সুবিধার নামে। বর্তমান
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যুগে এ বেতন
দিয়ে কীভাবে একটি পরিবার
চলে, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই
জানেন।
বেতনহীন মাসের পর মাসঃ
শিক্ষকতা না দিনমজুরি?
EFT (Electronic Fund Transfer) জটিলতায়
দেশের হাজার হাজার বেসরকারি
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তিন মাসের বেশি
সময় ধরে বেতন পাচ্ছেন
না। ফলে
তারা চরম অর্থকষ্টে দিন
কাটাচ্ছেন। গণমাধ্যমে
প্রায়ই শিরোনাম হয়— “তিন মাস
বেতন না পেয়ে দিনমজুরের
কাজে নামলেন শিক্ষক” কিংবা
“একটি ডিম তিনজনে ভাগ
করে খেতে বাধ্য হয়েছেন
শিক্ষক।” অথচ,
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট দফতর
বিষয়টি নিয়ে কার্যকর কোনো
ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। শিক্ষকদের
প্রতি এই চরম অবহেলা
ও উদাসীনতা কি দেশকে একটি
উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা উপহার দিতে পারবে?
শিক্ষকতা—সম্মানের মোহ, করুণ বাস্তবতা
সমাজে শিক্ষকতা ‘সম্মানের পেশা’ হিসেবে পরিচিত
হলেও বাস্তবতা বড়ই নির্মম।
একজন বেসরকারি শিক্ষক তার পরিবারের
জন্য পর্যাপ্ত আয় করতে পারেন
না, সন্তানের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে পারেন
না, এমনকি নিজের জন্যও
সামান্য সঞ্চয় করতে পারেন
না। পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তানদের
সামনে মাথা উঁচু করে
দাঁড়ানোর সুযোগটুকুও তাদের নেই।
বছরের পর বছর ধরে
এই পেশার প্রতি সরকার
ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষকদের
হতাশার গভীরে ঠেলে দিয়েছে।
দুঃসহ বৈষম্য ও অবহেলার
চক্র
বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অল্প বেতন , নেই
পর্যাপ্ত বাসাভাড়া, ভাতা, নেই ন্যূনতম
চিকিৎসা সুবিধা। তাদের
পেশাগত উন্নতি কিংবা কর্মস্থলে
নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও নেই। বছরের
পর বছর ধরে তারা
কর্তৃপক্ষের অবহেলা, দফতরের উদাসীনতা ও
নীতিনির্ধারকদের অসংবেদনশীলতার শিকার হয়ে আসছেন। তাদের
কণ্ঠস্বর শুনতে কেউ আগ্রহী
নয়, তাদের সমস্যার সমাধানে
কেউ কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
শিক্ষকতার মতো মহৎ পেশায়
থেকেও তারা জীবিকার তাগিদে
সংগ্রাম করতে বাধ্য হচ্ছেন। চরম
অর্থসংকটে পড়ে অনেকেই বিকল্প
পেশায় যুক্ত হচ্ছেন, কেউ
কেউ পেশা ছেড়ে দিতে
বাধ্য হচ্ছেন। অথচ
তাদের শ্রম, মেধা ও
নিষ্ঠার মাধ্যমেই দেশের লক্ষ লক্ষ
শিক্ষার্থী শিক্ষার আলো পাচ্ছে।
জাতীয়করণের দাবি: শিক্ষকদের বঞ্চনার
অবসান কোথায়?
বছরের পর বছর ধরে
শিক্ষকদের প্রতি নানা আশ্বাস
দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে
তার প্রয়োগ নেই।
শিক্ষকরা রাস্তায় নামেন, মানববন্ধন করেন,
দাবি উত্থাপন করেন—তবু পরিবর্তন
আসে না। EFT জটিলতায়
মাসের পর মাস বেতন
না পেয়ে শিক্ষকদের সংসার
চালানো দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অথচ নীতিনির্ধারকেরা বারবার শুধু প্রতিশ্রুতি
দিয়ে গেছেন।
শিক্ষকদের জাতীয়করণের দাবি নতুন কিছু
নয়। বহুবার
শিক্ষকেরা আন্দোলন করেছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি উত্থাপন
করেছেন। প্রতি
সরকারই জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়নের বেলায়
দেখা গেছে উদাসীনতা ।
প্রতিবার আশ্বাস দিয়ে সময়ক্ষেপণ
করা হয়, কিন্তু স্থায়ী
সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেওয়া
হয় না।
জাতীয়করণ করা হলে শিক্ষকদের
বেতন-ভাতা নিয়মিত হবে,
চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং তারা
আর্থিক ও সামাজিকভাবে সম্মানজনক
অবস্থানে থাকবেন। শিক্ষা
জাতীয়করণ ছাড়া এই সমস্যার
কোনো স্থায়ী সমাধান নেই। শিক্ষকদের
মর্যাদা রক্ষা করতে হলে
এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
নাহলে একসময় এই সমাজে
আর কেউ শিক্ষক হতে
চাইবে না।
লেখক পরিচিতি
মো: শরীফ হোসেন
সহকারি শিক্ষক আল-আজম হাইস্কুল এন্ড কলেজ
বিশ্বনাথ, সিলেট।