রবিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৫ ||

মুক্তদিন

প্রকাশ:

সোমবার, এপ্রিল ১৪, ২০২৫ || ০৯:২১

দেখা হয়েছে 62

আবুল কালাম আজাদ

হোম / মতামত

মতামত

বাংলা নববর্ষ বাঙালির মর্মমূল, অস্তিত্বের শিকড়

প্রকাশ:

সোমবার, এপ্রিল ১৪, ২০২৫ || ০৯:২১

62

আবুল কালাম আজাদ

বাংলা নববর্ষ বাঙালির মর্মমূল, অস্তিত্বের শিকড়

ছবিঃ মুক্তদিন

ঋতু পরিক্রমায় বৈশাখ আসবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম বৈশাখের সঙ্গে আসে কালবৈশাখী বৈশাখে থাকে গ্রীষ্মের তাপদাহ তারপরও বৈশাখের জন্য মানুষের আবাহন কেন? কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় বৈশাখের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনীতির সম্পর্কখাজনা আদায়, বর্গাচাষ, রবিশস্য ঘরে তোলা, হালখাতা উদযাপন ইত্যাদি যুক্ত হয়েছে বৈশাখী মেলার আয়োজন করে পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে পণ্যের বিকিকিনি মেলায়ও থাকে ৎসবের আমেজ, যা মানুষের দিনকে অন্যরকম করে তাকে পূর্ণতার পথে নিয়ে যাওয়ার ডাক দেয় ডাক অসংখ্য মানুষের বুকের ভেতরে থাকে, যারা সমাজকে সুস্থ রাখার চিন্তায় নিজেদের কর্মসূচি নির্ধারণ করে  

আমরা অনেকে ভুলে যাই, বাংলা নববর্ষ উদযাপন হলো বাঙালির আদিতম ৎসবগুলোর একটি প্রসঙ্গে . মুহম্মদ এনামুল হক বলেছেন, “কোনো নির্দিষ্ট বছরের সাথে নববর্ষের কোনো যোগ নেই, অর্থা কোনো ধরনের ৎসরের গণনার প্রারম্ভ থেকে কোনো দেশের অথবা জাতিরনববর্ষশুরু হয়নি হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে চলে আসা একটা বার্ষিক ৎসব। কোনো ধর্মের সাথেও নববর্ষের কোনো সম্পর্ক নেই ... আধুনিক নববর্ষের ৎসবের মধ্যে আদিম নববর্ষের পরিবর্তিত রূপ লুকিয়ে আছে তাই তার প্রাচীন অনুষ্ঠানাদিকে আধুনিক অনুষ্ঠানগুলোর মধ্য থেকে খুঁজে বের করতে হবে

আমি মনে করি, নববর্ষ দেশের সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক ৎসব। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের যে গণভিত্তি, তার শিকড় সুদূর অতীতে প্রোথিত ৎসবের সংযোগ আমাদের অস্তিত্ব আর অনুভূতির সঙ্গে জড়িত এটি আমাদের সাংস্কৃতিক মিলনক্ষেত্র

নববর্ষ এই দিনের মহাজাগতিক ৎসব, আনন্দ, মিলন, বন্ধন, ধর্মীয় আচরণের ঊর্ধ্বে মানবসত্যের জয়গান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের জাতীয় সংগীতের অমর রচয়িতা তিনি বৈশাখকে আবাহন করে লিখেছেন : ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরাএই দুটো পঙ্ক্তি একজন কবির শুধু ঋতুবন্দনা নয়; জীবনের কল্যাণে প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা বছর ধরে জমে ওঠা গ্লানি জীর্ণতা দূর করে ধরণীকে শুচি করার কথা বলেছেন বছরের আবর্জনা দূর হয়ে যাওয়ার মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন মন্ত্র ধূলি-মলিন জরাগ্রস্ত পৃথিবীর চেতনা; যে চেতনা জীবনকে পরিশুদ্ধ করে যে বোধ জীবনের অবমাননা ঘটায়; তাকে দূর করে জীবনের দার্শনিক সুন্দরকে প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন কবিগুরু সত্য মঙ্গলের সাধনার গভীর বোধটি বাংলা নববর্ষে সব বাঙালির ভেতরে থাকুক আহ্বান ধ্বনিত হয় দিনটিকে কেন্দ্র করে বৈশাখের তাপদাহ শুধু পোড়ায় না; তাকে সুন্দর, স্নিগ্ধও করে

আমরা জানি, সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন তিনি পঞ্জিকা বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ নেন হিজরি সন সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের বছরকে যুক্ত করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয় বলা হয়ে থাকে, ফসল কাটার মৌসুমে খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য এই সন চালু করা হয়েছিল হিজরি সন হলো চান্দ্র সন চাঁদ দেখে গণনার ওপর সনের ভিত্তি বাংলা সৌর সন সৌর সনে দিনক্ষণ গণনা সহজ এবং এর একটি নির্দিষ্ট ভিত্তি আছে সম্রাট আকবরের উপদেষ্টা আমির ফতেউল্লাহ সিরাজী বাংলা মাসের নামগুলো নক্ষত্রের নাম থেকে নিয়ে সৌর মাসের দিন মিলিয়ে বাংলা সন প্রবর্তন করেন ব্যাপারে ১৫৮৫ সালের ১০ মার্চ সম্রাটের নির্দেশনামা জারি হয় তবে এর কার্যকারিতা দেখানো হয় ১৫৫৬ সালের ১১ মার্চ থেকে কারণ ওই দিনটি ছিল সম্রাট আকবরের সিংহাসনে বসার তারিখ সেই থেকে শুরু

নিজস্ব বর্ষপঞ্জি যে কোনো জাতির সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের একটি বড় দিক এই অর্থে বাংলা নববর্ষ বাঙালির এক মহান জাতীয় দিন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ এই দিন জাতিগত ঐক্যের দৃঢ় বন্ধনের দিন ভবিষ্যতের শুভসূচনা এই দিনের মধ্যে নিহিত বাঙালি এই দিনের মর্মবাণীর সাধনায় এক হতে পারলে তার আত্মশক্তির জাগরণ অটুট থাকবে এই অর্থে বাংলা সন বাঙালির দিনযাপনের সঙ্গে যতটা না সম্পৃক্ত, তার চেয়ে অনেক বেশি সম্পৃক্ত জাতিগোষ্ঠীর মানবিক বোধের সাধনার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের দীপশিখায় এটাই বাংলা বর্ষপঞ্জির উজ্জ্বল দিক

এখন বাঙালি সংস্কৃতির একটি বৃহ মৌল উপাদান বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত ৎসব এবং বৈশাখী মেলা এটি শুধু সংস্কৃতি নয়; অর্থনীতিও অর্থা ৎপাদন শক্তির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিকে প্রভাবিত করে বাংলা নববর্ষ এভাবে লোকজ জীবনের সাংস্কৃতিক ধারাকে বাংলা সন দিয়েছে গতি, যে গতি এখন আমাদের জীবনে বিভিন্ন দিক থেকে হয়েছে তাৎপর্যমণ্ডিত।

বৈশাখী মেলায় থাকে ৎসবের আমেজ চিত্রিত হাঁড়ি-সরা-কলসি, মাটির পুতুল-হাতি-ঘোড়া, আম আঁটির ভেঁপু, শুকনো নিমকি, বাতাসা-মোয়া, নাড়ু-পিঠা ইত্যাদির ঘটা থাকে বাঁশের কারুকাজ করা বৈচিত্র্যময় সাংসারিক উপকরণ আরও কত কী! আমরা প্রার্থনার মতো উচ্চারণ করিবাংলার মাটি হোক শস্যবতী, নদী হোক জলবতী; বাঙালির উদ্যম হোক কল্যাণমুখী মানুষ যেন পশু না হয় মানুষের হৃদয়ে যেন মানুষেরই ছায়া বিরাজমান থাকে

মনে রাখতে হবে, বাংলা নববর্ষ বাঙালির মর্মমূল; অস্তিত্বের শিকড় বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তি শুধু বাঙালি নয়; এই অঞ্চলের অপরাপর জনগোষ্ঠীরও নববর্ষ উদযাপিত হয় কমবেশি একই সময়ে এর মধ্যে রয়েছে এক বৃহ ঐক্যের বীজ কারণেই সম্ভবত বিভাজনকামী পাকিস্তান সরকার অনুষ্ঠানটি বর্জন করেছিল এমনকি দিনটির সরকারি ছুটিও বাতিল করেছিল তাদের অনুধাবন ছিলবাঙালির ঐক্যের এক অমোঘ শক্তি ৎসব। শুধু তা- নয়; বাঙালি জাতি গঠন এবং সংস্কৃতির প্রবহমানতা অক্ষুণ্ন রাখার ব্যাপারে ৎসবের অবদান অনস্বীকার্য প্রতিবছর ৎসব উপলক্ষে বাঙালি মিলিত হয় প্রয়োজনে বাঙালি বারবার মিলিত হবে গণপ্রতিরোধকে প্রতিহত করার ক্ষমতা কারও নেই এই দিনের ঐতিহ্য রক্ষা করা প্রত্যেক বাঙালির কর্তব্য

 


লেখকঃ আবুল কালাম আজাদ

বিতার্কিক, প্রাবন্ধিক সংস্কৃতিকর্মী

 

 


-----Ad1----